
জুমার খুতবা (খুৎবা) হলো জুমার নামাজের পূর্বে প্রদত্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ উপদেশমূলক ভাষণ, যা ইসলামী শরিয়তের একটি অংশ। এটি দুই ভাগে বিভক্ত এবং এটি জুমার নামাজের পূর্বশর্ত। নিচে বিস্তারিতভাবে জুমার খুতবার কাঠামো, নিয়ম ও গুরুত্ব তুলে ধরা হলো:
জুমার খুতবার গুরুত্ব
- খুতবা ছাড়া জুমার নামাজ হয় না।
খুতবা হলো জুমার নামাজের অংশ। এটা ফরজ না হলেও শর্ত—খুতবা না হলে জুমার নামাজ সহিহ হয় না। - রাসূল (সা.) প্রতিটি জুমায় খুতবা দিতেন।
তিনি সমাজ, ন্যায়-অন্যায়, আল্লাহভীতি ও জীবনের নানা দিক নিয়ে আলোচনা করতেন।
খুতবার কাঠামো (দুই খণ্ডে বিভক্ত)
প্রথম খুতবা:
- হamd বা আল্লাহর প্রশংসা:
খুতবা শুরু হয় “الحمد لله” (আলহামদুলিল্লাহ) দিয়ে। - দরুদ শরীফ:
রাসূল (সা.) এর প্রতি সালাম ও দরুদ পাঠ করা হয়। - তাওহিদ ও তাকওয়া বিষয়ক আলোচনা:
আল্লাহর ভয়, জীবন পরিচালনার নির্দেশনা ও পাপ থেকে বিরত থাকার উপদেশ থাকে। - কুরআনের আয়াত বা হাদীস পাঠ:
খুতবার ভেতর প্রাসঙ্গিক আয়াত ও হাদীস পাঠ করা হয়। - সামাজিক ও নৈতিক বিষয়ে নসিহত:
যেমন: অন্যায় পরিহার, সততা, সদাচরণ, পারিবারিক দায়িত্ব ইত্যাদি। - দোয়া:
সাধারণত প্রথম খুতবা শেষে কিছুক্ষণ বসে থাকেন ইমাম।
দ্বিতীয় খুতবা:
- আবারও আল্লাহর প্রশংসা ও দরুদ।
- ছোট করে তাকওয়ার উপদেশ।
- মুসলিম উম্মাহর জন্য দোয়া ও কল্যাণ কামনা।
- অসুস্থ, গরীব, নির্যাতিতদের জন্য মাগফিরাত চাওয়া।
- সালাতের দাওয়াত:
“أقِمِ الصلاة” বা “الصلاة جامعة” বলে নামাজের আহ্বান।
খুতবার সময় করণীয় (মুসল্লীদের জন্য):
মনোযোগ দিয়ে খুতবা শোনা ফরজ।
খুতবার সময় কথা বলা, মোবাইল দেখা বা কাউকে ইশারায়ও বিরক্ত করা নিষেধ।
হাদীস: “যদি তুমি কাউকে বলো খুতবার সময় চুপ থাকতে, তবে তুমিও অন্যায় করেছো।” — (বুখারী)
খুতবার ভাষা
মূলত আরবি ভাষায় খুতবা হওয়া সুন্নত।
অনেক মসজিদে প্রথম খুতবা আরবি, দ্বিতীয় খুতবা সংক্ষিপ্ত আরবি এবং মাঝে স্থানীয় ভাষায় উপদেশ দেওয়া হয়।
উপসংহার:
জুমার খুতবা শুধু একটি বক্তৃতা নয়, বরং একটি ইবাদত এবং ইসলামের মৌলিক শিক্ষাগুলোর স্মরণ করিয়ে দেওয়ার অন্যতম মাধ্যম। তাই মুসল্লিদের উচিত এটাকে শ্রদ্ধার সঙ্গে শোনা ও সেই অনুযায়ী জীবন গঠন করা।
জুমার খুতবার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
- প্রথম জুমার খুতবা:
রাসূলুল্লাহ (সা.) যখন মদিনায় হিজরত করলেন, তখন প্রথম জুমার খুতবা প্রদান করেন কুবা মসজিদের কাছাকাছি একটি জায়গায়। এটাই ইসলামে প্রথম আনুষ্ঠানিক জুমার খুতবা হিসেবে ধরা হয়। - খিলাফতের যুগে খুতবা:
খিলাফতের যুগে খতিবরা সমাজের সমস্যাবলী, যুদ্ধের পরিস্থিতি, অর্থনৈতিক দিক ইত্যাদি খুতবার মাধ্যমে জনগণকে জানাতেন। খুতবা ছিল রাষ্ট্রীয় বার্তার মাধ্যম।
খুতবার সময়ে খতিবের জন্য করণীয়
খুতবার সময় খতিব দাঁড়িয়ে থাকেন।
মাঝখানে একবার বসা সুন্নত (প্রথম ও দ্বিতীয় খুতবার মাঝে সংক্ষিপ্ত বিরতি)।
খুতবা সংক্ষিপ্ত ও প্রাঞ্জল হওয়া উত্তম।
কুরআন ও সহীহ হাদীসের আলোকে খুতবা প্রদান করা আবশ্যক।
খুতবার বিষয়বস্তু কী হতে পারে?
খুতবা শুধু ধর্মীয় উপদেশ নয়, বরং এটি হতে পারে:
নৈতিকতা, ইনসাফ, সততা ও সামাজিক দায়বদ্ধতা
পরিবার ও বিবাহ বিষয়ক নির্দেশনা
যুব সমাজের পথপ্রদর্শন
নেশা, দুর্নীতি, গীবত, ঘুষ ইত্যাদি থেকে বিরত থাকার আহ্বান
সময়োপযোগী সমাজ সচেতনতা (যেমন: গাজার মুসলমানদের জন্য দোয়া, ইসলামোফোবিয়া বিষয়ে সচেতনতা)
মৃত্যু ও আখিরাত স্মরণ
জুমার খুতবার সময় কিছু দোয়া ও আয়াত যা খতিব পড়ে থাকেন
খুতবার শুরুতে:
إِنَّ الْحَمْدَ لِلَّهِ نَحْمَدُهُ وَنَسْتَعِينُهُ وَنَسْتَغْفِرُهُ…
তাকওয়ার নির্দেশ:
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ حَقَّ تُقَاتِهِ وَلَا تَمُوتُنَّ إِلَّا وَأَنْتُم مُّسْلِمُونَ
— (সূরা আলে ইমরান, ৩:১০২)
দোয়া অংশে:
اللَّهُمَّ اغْفِرْ لِلْمُؤْمِنِينَ وَالْمُؤْمِنَاتِ، وَالْمُسْلِمِينَ وَالْمُسْلِمَاتِ…
বর্তমানে জুমার খুতবার চ্যালেঞ্জ ও সুযোগ
চ্যালেঞ্জ:
অনেক জায়গায় খুতবা কেবল রুটিন দায়িত্বে পরিণত হয়েছে।
সমাজের সমস্যা বা বাস্তব দিক উপেক্ষিত হয়।
তরুণ প্রজন্ম মনোযোগ হারিয়ে ফেলছে।
সুযোগ:
ইসলামি শিক্ষা ও সচেতনতা জাগাতে এটি সবচেয়ে বড় সাপ্তাহিক প্ল্যাটফর্ম।
আধুনিক মাধ্যম ব্যবহার করে (যেমন: খুতবা লাইভ করা) তরুণদের আকর্ষণ করা সম্ভব।
যদি সময়োপযোগী খুতবা হয়, তবে সমাজে ইতিবাচক প্রভাব ফেলা সম্ভব।
উপসংহার:
খুতবা শুধু একটি আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত ও সমাজ উন্নয়নের হাতিয়ার। খতিব ও মুসল্লিদের উভয়ের উচিত এর গুরুত্ব বোঝা এবং যথাযথভাবে পালন করা।
জুমার খুতবা: বিশেষ আমল ও সুন্নত
খুতবার আগে সুন্নত নামাজ
খুতবার আগেই যারা মসজিদে যায়, তাদের জন্য দুই বা চার রাকাআত সুন্নত নামাজ পড়া সুন্নত।
রাসূল (সা.) বলেছেন, “যে ব্যক্তি জুমার দিনে গোসল করল, তারপর যতটুকু লেখা হয়েছে ততটুকু নামাজ পড়ল, তারপর ইমাম আসার পর চুপ করে খুতবা শুনল, তার পূর্ববর্তী জুমা থেকে পরবর্তী জুমা পর্যন্ত এবং আরও তিনদিনের গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়।”
— (সহীহ মুসলিম)
খুতবার সময়ের দোয়ার গুরুত্ব
অনেক আলেম বলেন, খুতবার মাঝে বা শেষে খতিবের দোয়ায় “আমিন” মনে মনে বলা যায়।
এ সময় হাত তোলা সুন্নত নয়, তবে মনোযোগ দিয়ে শোনা গুরুত্বপূর্ণ।
জুমার খুতবা ও সময় ব্যবস্থাপনা
খুতবা সংক্ষিপ্ত রাখার নির্দেশ
রাসূল (সা.) বলেছেন:
“যে ব্যক্তি খুতবা সংক্ষিপ্ত রাখে ও নামাজ দীর্ঘ করে, সে বিদ্বান ব্যক্তি।”
— (সহীহ মুসলিম)
উপদেশ:
খুতবা যেন ১০–১৫ মিনিটের মধ্যে শেষ হয়, যাতে মানুষ মনোযোগ ধরে রাখতে পারে এবং বিরক্ত না হয়।
আধুনিক প্রেক্ষাপটে খুতবার প্রভাব বাড়ানোর উপায়
১. বিষয়ভিত্তিক খুতবা সিরিজ চালু করা:
প্রতি সপ্তাহে নির্দিষ্ট একটি বিষয় নিয়ে ধারাবাহিক আলোচনা। যেমন:
তাকওয়া
পারিবারিক সম্পর্ক
যুবকদের চরিত্র গঠন
প্রযুক্তি ও মুসলমানদের ভূমিকা
২. স্থানীয় সমস্যা ও সামাজিক বার্তা:
যেমন:
মাদক প্রতিরোধ
পরিবেশ সচেতনতা
শিক্ষার গুরুত্ব
গরীব প্রতিবেশীর হক
৩. যুবকদের টানার উপায়:
সহজ ভাষায় কথা বলা
বাস্তব উদাহরণ ব্যবহার করা
খুতবার মাঝে ছোট কুইজ বা প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়া (যদিও খুতবার শুদ্ধতা রক্ষা করতে হবে)
খুতবা দেওয়ার জন্য খতিবের প্রস্তুতি (Checklist)
বিষয় নির্বাচন: সমাজ উপযোগী ও কুরআন-হাদীসসম্মত
খুতবা লিখিত বা নোট করা
আয়াত ও হাদীস মুখস্থ বা পাঠের ব্যবস্থা
ভয়ভীতির সাথে নয়, ভালোবাসা ও দয়া নিয়ে বক্তব্য দেওয়া
শ্রোতাদের মানসিকতা বোঝা এবং ভাষা সহজ রাখা
একটি কার্যকর জুমার খুতবার উদাহরণ বিষয়: “পরিবারে ইসলামী মূল্যবোধ”
প্রথম খুতবায়:
আল্লাহর প্রশংসা, দরুদ, তাকওয়ার উপদেশ
কুরআনের আয়াত: “হে মুমিনগণ, তোমরা নিজেদের ও তোমাদের পরিবারকে আগুন থেকে রক্ষা করো।” (সূরা তাহরীম ৬)
দুনিয়ায় সফল পরিবার গঠনে ইসলামের ভূমিকা
দ্বিতীয় খুতবায়:
মুসলমানদের পরিবারে দয়া, ক্ষমা ও সহনশীলতা
সন্তানের প্রতি দায়িত্ব, স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক সম্মান
সকল মুসলিম পরিবারের শান্তি কামনায় দোয়া