ঢাকারবিবার , ৩ আগস্ট ২০২৫
  1. আন্তর্জাতিক
  2. খেলাধুলা
  3. জাতীয়
  4. ধর্ম
  5. প্রযুক্তি
  6. সারাদেশ

ভূঞাপুর হাসপাতালে ছাদ চুইয়ে পানি, নষ্ট যন্ত্রপাতি ও সেবার বেহাল দশা

প্রতিবেদক
admin
আগস্ট ৩, ২০২৫ ১১:৫৪ পূর্বাহ্ণ

এম মুহাম্মাদ নাজমুল হক :

টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের দুরবস্থা যেন দিনকে দিন আরও ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। বছরের পর বছর ধরে চলে আসা অব্যবস্থাপনা, সেবার অভাব, যন্ত্রপাতি বিকল থাকা এবং অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের কারণে এই সরকারি হাসপাতাল কার্যত এখন ‘রোগীদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ জায়গা’ হয়ে উঠেছে।

গত এপ্রিলেও সময়ের কণ্ঠস্বরে হাসপাতালের নাজুক পরিস্থিতি নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। এরপর কিছুটা তৎপরতা দেখা গেলেও পরিস্থিতির কোনো টেকসই উন্নয়ন হয়নি। বরং সম্প্রতি ছাদ চুইয়ে বৃষ্টির পানি ওয়ার্ডে ঢুকে ভর্তি রোগীদের বিছানায় পড়ার মতো ঘটনা স্থানীয়দের মধ্যে চরম ক্ষোভ ও হতাশা তৈরি করেছে।শনিবার (২ আগস্ট) সকালে সরেজমিনে হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, শিশু ওয়ার্ডের ছাদ দিয়ে টপটপ করে বৃষ্টির পানি পড়ছে রোগীদের বিছানায়। এতে করে কেউ বিছানায় শুয়ে চিকিৎসা নিতে পারছে না, কেউ দাঁড়িয়ে বা বিছানার একপাশে বসে কোনোমতে সময় পার করছে। মেঝে জুড়ে ছড়িয়ে থাকা পানি থেকে উঠছে দুর্গন্ধ। এমন পরিবেশে চিকিৎসা নিচ্ছে শিশু রোগীরা।

এছাড়া ওয়ার্ডে থাকা ৬টি বৈদ্যুতিক ফ্যানের মধ্যে সচল মাত্র একটি। ফলে তীব্র গরমে শিশুদের শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। স্বজনরা ঘর থেকে আনা হাতপাখা বা চার্জার ফ্যান দিয়ে বাচ্চাদের ঠান্ডা রাখার চেষ্টা করছেন। শুধু তাই নয়, শ্বাসকষ্ট বা ঠান্ডাজনিত রোগে ব্যবহৃত নেবুলাইজার মেশিনটিও বিকল। বৈদ্যুতিক সংযোগ দিলেই যন্ত্রের ভেতরে আগুনের স্ফুলিঙ্গ দেখা দেয়, ফলে সেটি ব্যবহার করাই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। রোগীর স্বজনরা বাধ্য হয়ে বাইরে থেকে নেবুলাইজার মেশিন কিনে আনছেন।

ভর্তি থাকা এক শিশু রোগীর মা সময়ের কণ্ঠস্বরকে বলেন, ‘চার দিন ধরে ছেলেকে নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি আছি। কোনো হাসপাতালের পরিবেশ এমন হতে পারে না। অসুস্থ হয়ে আসি চিকিৎসা নিতে, উল্টো এখানে আসলে সুস্থ মানুষও অসুস্থ হয়ে যায়। ছাঁদ থেকে পানি পড়ে বিছানায়। ছোট বাচ্চা নিয়ে রাতে শুতে পারি না, বসে থাকতে হয়। ওষুধপত্র অধিকাংশই বাইরে থেকে আনতে হয়। ফ্যান চলে না, বাচ্চার গ্যাস দিতে হয়, সেই মেশিনও নষ্ট।

বীরহাটির শরিফ নামে একজন বলেন, ‘ঢাকায় থাকি, ছেলেকে নিয়ে গ্রামে ঘুরতে এসেছিলাম। হঠাৎ করে বাচ্চা অসুস্থ হয়ে পড়ায় গতকাল সন্ধ্যায় হাসপাতালে নিয়ে আসি। কিন্তু এখানকার অবস্থা এতটাই খারাপ ছিল যে ভর্তি করিয়েও বাধ্য হয়ে রাতে ফিরে যেতে হয়। আজ সকালে শ্বাসকষ্ট বেড়ে যাওয়ায় আবার আসতে হয়েছে।’

তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘এই হাসপাতালের অবস্থা ভয়াবহ। একটু বৃষ্টি হলেই ছাদ চুইয়ে পানি পড়ে, শিশু ওয়ার্ডের অবস্থা সবচেয়ে বাজে। এখানে ন্যূনতম চিকিৎসাসেবাও পাওয়া যায় না। এমন পরিবেশে একজন সুস্থ মানুষও অসুস্থ হয়ে মারা যাবে।’

এদিকে পুরুষ ওয়ার্ডেও দেখা মেলে একই চিত্র। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, শয্যার অভাবে অনেক রোগী মেঝেতে চিকিৎসা নিচ্ছেন। শ্বাসকষ্টের রোগীরা অভিযোগ করছেন, নিয়মিত গ্যাস নেওয়ার প্রয়োজন হলেও হাসপাতালের নেবুলাইজার মেশিন বিকল থাকায় সেবা থেকে তারা বঞ্চিত হচ্ছেন।

ঠান্ডু ভূঁইয়া নামে এক রোগী বলেন, ‘দুই দিন ধরে ঠান্ডা, জ্বর ও শ্বাসকষ্ট নিয়ে ভর্তি আছি। দুই-একটা ওষুধ ছাড়া সব ওষুধ বাইরে থেকে কিনে আনতে হয়। গ্যাস দেওয়ার মেশিনটা নষ্ট, তাই বাইর থেকে এনেছি। বর্তমানে হাসপাতালের সেবার মান খুবই খারাপ।’

আব্দুস সালাম নামে মেগার পটল থেকে আরেক রোগী বলেন, ‘তিনদিন ধরে ভর্তি আছি। দিনে একবার ডাক্তার আসে। আমাকে গ্যাস দেওয়া দরকার, ঐটা দিতে পারলে আমি সুস্থ হইতাম। কিন্তু তিনদিনেও আমি পাইনাই। এখন শুনতাছি মেশিন নষ্ট।’

প্রতিবেদক সরেজমিনে হাসপাতালে অবস্থানকালে বেলা ১১টা ৫০ মিনিটে চিকিৎসক নিশাত জাহান পুরুষ ওয়ার্ডে প্রবেশ করে ১৭ জন রোগীর অবস্থা পর্যালোচনা করেন এবং মাত্র ২০ মিনিট পর, অর্থাৎ ১২টা ১০ মিনিটে ওয়ার্ড ত্যাগ করেন। গড়ে প্রতি রোগীর জন্য এক মিনিটেরও কম সময় বরাদ্দ থাকায় পর্যাপ্ত সেবা নিশ্চিত হয়েছে কি না—সে প্রশ্ন তোলেন রোগী ও স্বজনরা।

এ বিষয়ে হাসপাতালের দায়িত্বপ্রাপ্ত চিকিৎসকরা মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নার্স বলেন, ‘জনবল সংকট তীব্র। আমরা তেমনটা সেবা দিতে পারছি না। মাত্র ১০ জন নার্স কাজ করছি, এর মধ্যে তিনজন নিজেরাই চিকিৎসাধীন। বাকিরা ভাগ ভাগ করে যতটুকু পারি সেবা দিচ্ছি।’

অব্যবস্থাপনার দায় স্বীকার করে ভূঞাপুর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. আব্দুস সোবহান সময়ের কণ্ঠস্বরকে বলেন, ‘আমি বারবার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। সম্প্রতি সিভিল সার্জন স্যার এসে পরিদর্শন করেছেন। অচিরেই সমস্যার সমাধান হবে।’

নেবুলাইজার মেশিন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘মেশিনটা বিকল হয়ে গেছে। ইদানীং রোগীর চাপ বেড়েছে। মেশিনের জন্য চিঠি দিয়েছি, দ্রুত কিনে আনা হবে বা অন্য হাসপাতাল থেকে বিকল্প ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

জেলা সিভিল সার্জন ডা. ফরাজী মুহাম্মদ মাহবুব আলম মঞ্জু বলেন, ‘আমি গত বুধবার ভূঞাপুর হাসপাতাল পরিদর্শন করেছি। যেসব সমস্যা চিহ্নিত হয়েছে, সেগুলোর দ্রুত সমাধানে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।’

উল্লেখ্য, এর আগে চলতি বছরের ১৮ এপ্রিল ‘ভূঞাপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স যেন দুর্ভোগের এক স্থায়ী ঠিকানা!’ সেখানে বিদ্যুৎ না থাকা, জেনারেটর চালু না হওয়া, ব্যবহার অনুপযোগী টয়লেট, চিকিৎসক-নার্সদের অনুপস্থিতি ও সেবার ঘাটতিসহ নানা সমস্যার তথ্য উঠে আসে। সেই সময় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিলেও বাস্তবে এর কোনো প্রতিফলন ঘটেনি, বরং পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটেছে।

স্থানীয়দের অভিযোগ, ২০২২ সালে ডা. মোহাম্মদ আব্দুস সোবহান উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা (টিএইচও) হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই হাসপাতালের সার্বিক ব্যবস্থাপনায় নৈরাজ্য, অবহেলা ও অনিয়ম প্রকট হয়ে উঠেছে। তার প্রশাসনিক উদাসীনতা, নজরদারির ঘাটতি এবং দায়িত্বহীন আচরণের ফলে চিকিৎসাসেবা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।

অনেকেই মনে করেন, ডা. সোবহানের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরেই নানা অনিয়ম ও দুর্ব্যবস্থাপনার অভিযোগ থাকলেও সংশ্লিষ্ট মহলের ‘নীরব সমর্থন’ এবং রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ার কারণে তার বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। ফলে হাসপাতালটির অবস্থার অবনতি অব্যাহত রয়েছে।

সর্বশেষ - প্রযুক্তি