16 Apr 2025, Wed

মুসলিমদের ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক অস্তিত্বের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় যুদ্ধ

ইসলামি সমাজে এক কল্যাণময় দানের ধারা হিসাবে শুরু হয় ভারতের ওয়াক্ফ আইনের ইতিহাস, যা মসজিদ, মাদরাসা, কবরস্থান, দরগাহ ও গরিবদের সেবায় ব্যবহৃত হতো। এই ওয়াক্ফব্যবস্থা মুসলিমসমাজের শিক্ষা, ধর্মীয় ও সামাজিক জীবনকে যুগ যুগ ধরে এগিয়ে নিয়েছে। কিন্তু হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক শক্তিগুলোর কাছে এই সমৃদ্ধ ঐতিহ্য বরাবরই গাত্রদাহের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ইতিহাসের পাতায় বাবরি মসজিদের ধ্বংস, মথুরা ও কাশির ওপর আগ্রাসী দাবি, বিভিন্ন ওয়াক্ফ সম্পত্তি দখল ও অপব্যবহার—সবই এক ধারাবাহিক শোষণ-নিপীড়নের প্রতিফলন। এরই ধারাবাহিকতায় ২০২৫ সালে ‘Waqf (Amendment) Bill’ পাস করে বিজেপি সরকার।

এই বিলে এমন কিছু ধারা যোগ করা হয়েছে, যার ফলে মুসলমানদের ওয়াক্ফ সম্পত্তির ওপর সরকারি হস্তক্ষেপ, দখলদার বলে অভিযুক্ত করার সুযোগ, পূর্ববর্তী ওয়াক্ফ রেকর্ড বাতিলের অধিকার এবং পারিবারিক ওয়াক্ফকে (Waqf-alal-Aulad) হুমকির মুখে ফেলা হয়েছে। আইনত এটি ওয়াক্ফ বোর্ডকে একটি ‘rubber stamp’ প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছে এবং মুসলমানদের ধর্মীয় ও সামাজিক জীবনের ভিত্তিমূল কাঁপিয়ে দিয়েছে।

ভারতে ওয়াক্ফ আইন প্রথম প্রণয়ন হয় ১৯৫৪ সালে এবং পরে ১৯৯৫ সালে তা সংশোধন করে নতুন রূপে প্রণয়ন করা হয়। এই আইনের মাধ্যমে মুসলিমসমাজ তাদের দানকৃত জমি, মসজিদ, মাদরাসা, কবরস্থানসহ নানা সামাজিক ধর্মীয় সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণ এবং ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারে। ওয়াক্ফ বোর্ডের মাধ্যমে এসব সম্পদ পরিচালিত হয়, যা মুসলিমদের শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, ধর্মীয় চর্চা ও দারিদ্র্যবিমোচনে বিশাল ভূমিকা রাখে।

কেন ওয়াক্ফ সহ্য হয় না হিন্দুত্ববাদীদের?

মুসলিমদের এক সুসংগঠিত ধর্মীয় ও সম্পদভিত্তিক ব্যবস্থাপনা হিন্দুত্ববাদী শক্তির চোখে খচখচ করছে বহুদিন ধরে। তারা বারবার দাবি করেছে, ওয়াক্ফ সম্পদ সরকারের তদারকির বাইরে আর মুসলিমসমাজ গোপনে এই সম্পদ ব্যবহার করে নিজেদের আলাদা পরিচয় ও ক্ষমতা গড়ে তুলছে, যা তাদের তথাকথিত ‘হিন্দুরাষ্ট্র’ ধারণার পরিপন্থী।

মুসলিম ঐতিহ্যবাহী স্থানগুলোর ধ্বংসযজ্ঞ

উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা ইতোমধ্যেই বাবরি মসজিদ (১৯৯২), গুজরাটের শতবর্ষ প্রাচীন মসজিদ, গিয়াসউদ্দিন তুঘলকের মাজারসহ বহু মুসলিম প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ধ্বংস করেছে। এই ধারা এখনো চলছে, কাশি ও মথুরার ঐতিহাসিক মসজিদ নিয়েও মামলা চলছে।

ওয়াক্ফ (সংশোধনী) বিল-২০২৫ : একটি বিপজ্জনক বাঁক

নতুন বিলের মাধ্যমে ১০টি ধারা সংশোধন ও সংযোজন করা হয়েছে। এসব ধারার মূল উদ্দেশ্য হলো ওয়াক্ফ বোর্ডের হাত থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে সরকারের হাতে কুক্ষিগত করা। ওয়াক্ফ সংশোধনী বিল ২০২৪-এর প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ ধারা ও পরিবর্তনে এবং মুসলিম সম্প্রদায়ের আপত্তির মূল কারণগুলো :

১. ওয়াক্‌ফ ঘোষণার শর্ত কঠোরকরণ

বিলের ধারা : যেকোনো ব্যক্তি শুধু তখনই ওয়াক্ফ ঘোষণা করতে পারবেন, যদি তিনি পাঁচ বছর ধরে ইসলাম ধর্ম পালন করে থাকেন এবং সেই সম্পত্তির বৈধ মালিক হন।

মুসলিমদের আপত্তি : আগে ধর্মীয় অনুভূতি থেকে কেউ তাৎক্ষণিকভাবে ওয়াক্ফ করতে পারতেন; এখন তা কঠিন করে দেওয়া হয়েছে। পাঁচ বছরের ধর্ম পালনের প্রমাণের শর্তটি কানুনি জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে এবং স্বেচ্ছায় ওয়াক্ফ দান করার আগ্রহে বাধা হতে পারে। অনেক সময় নতুন মুসলিম বা সদ্য তাওবা করে ধর্মে ফিরে আসা কেউ চাইলে ওয়াক্ফ করতে পারবে না।

২. ব্যবহার দ্বারা ওয়াক্ফ (Usage-based waqf) বিলুপ্তি

বিলের ধারা : ‘ব্যবহার দ্বারা ওয়াক্ফ’Ñ অর্থাৎ দীর্ঘদিনের ধর্মীয় ব্যবহারে যে সম্পত্তি ওয়াক্ফ বলে গণ্য হতো, তা বাতিল করা হয়েছে।

মুসলিমদের আপত্তি : বহু পুরাতন মসজিদ, কবরস্থান ইত্যাদি অনেক জায়গা লিখিত দলিল ছাড়াই ওয়াক্ফ বলে স্বীকৃত ছিল। এই ধারা বাতিল মানেই বহু ধর্মীয় স্থাপনা এখন জমিবিরোধে পড়ে যাবে বা সরকারি সম্পত্তি হিসেবে দাবি করা হতে পারে। এটি ঐতিহাসিক মসজিদ ও কবরস্থানের অস্তিত্ব ঝুঁকিতে ফেলতে পারে।

৩. ওয়াক্ফ-আলাল-আউলাদ (পরিবারের জন্য ওয়াক্ফ) সীমাবদ্ধতা

বিলের ধারা : পরিবারের সদস্যদের জন্য ওয়াক্ফ করলে তা যেন উত্তরাধিকারের হক (বিশেষ করে নারীদের হক) লঙ্ঘন না করে, এমন শর্ত দেওয়া হয়েছে।

মুসলিমদের আপত্তি : ইসলামি শরিয়তে নির্ধারিতভাবে আলাল-আউলাদ ওয়াক্ফ অনুমোদিত, তবে এই আইন তা ধর্মীয় নিয়মের ওপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ প্রয়োগ করছে। নারীর হক রক্ষার অজুহাতে অনেক আলাল-আউলাদ ওয়াক্ফ বাতিল বা চ্যালেঞ্জ হতে পারে।

৪. ওয়াক্ফ জরিপের দায়িত্ব জেলা কালেক্টরকে দেওয়া

বিলের ধারা : জরিপ কমিশনারের পরিবর্তে জেলা কালেক্টর (একজন সরকারি কর্মকর্তা) ওয়াক্ফ জরিপ পরিচালনা করবেন।

মুসলিমদের আপত্তি : কালেক্টর বা আমলা অনেক সময় ধর্মীয় সংবেদনশীলতা বোঝেন না বা রাজনৈতিক প্রভাবাধীন হতে পারেন। এটি ওয়াক্ফ জরিপে পক্ষপাতিত্ব ও ভুলের ঝুঁকি বাড়ায়। স্থানীয় মুসলিম নেতৃত্বকে উপেক্ষা করে ওয়াক্ফ ব্যবস্থাপনায় আমলাতান্ত্রিক হস্তক্ষেপ বেড়ে যাবে।

৫. কেন্দ্রীয় ওয়াক্ফ কাউন্সিলে অমুসলিম সদস্য অন্তর্ভুক্তি

বিলের ধারা : ওয়াক্ফ কাউন্সিলে দুজন অমুসলিম সদস্য থাকতে পারবেন। সংসদ সদস্য, বিচারপতি, বিশিষ্ট ব্যক্তিÑ সবাই মুসলিম হওয়া এখন বাধ্যতামূলক নয়।

মুসলিমদের আপত্তি : ওয়াক্ফ একটি ধর্মীয় বিষয়। অমুসলিম কেউ ধর্মীয় নিয়ম বুঝবেন না এবং সিদ্ধান্তে পক্ষপাতিত্ব বা ভুল হতে পারে। এটি ধর্মীয় স্বায়ত্তশাসনে হস্তক্ষেপ। মুসলিমসমাজের মতে, নিজস্ব ধর্মীয় সম্পত্তি ব্যবস্থাপনায় মুসলমানরাই পূর্ণাঙ্গ নিয়ন্ত্রণে থাকা উচিত।

৬. রাজ্য ওয়াক্ফ বোর্ডে অমুসলিম সদস্য

বিলের ধারা : ওয়াক্ফ বোর্ডের অমুসলিম সদস্য অন্তর্ভুক্ত করা বাধ্যতামূলক।

মুসলিমদের আপত্তি : যেমনটি কেন্দ্রীয় পর্যায়ে, তেমনি রাজ্যপর্যায়েও অমুসলিম সদস্যের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা থাকলে ধর্মীয় বিষয়ের বিকৃতি ঘটতে পারে। এটি মুসলমানদের নিজ ধর্মের ওপর সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার ক্ষুণ্ণ করে।

৭. ওয়াক্ফ ট্রাইব্যুনাল ও আপিল

বিলের ধারা : ট্রাইব্যুনালে সদস্যসংখ্যা কমানো হয়েছে এবং আপিল এখন হাইকোর্টে করতে হবে।

মুসলিমদের আপত্তি : আগে ওয়াক্ফ বোর্ডের অভ্যন্তরীণ সিদ্ধান্তই গুরুত্বপূর্ণ ছিল, এখন সরকারি ট্রাইব্যুনাল ও হাইকোর্টে নির্ভরশীলতা বেড়েছে। এতে সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল মামলা বেড়ে যাবে।

৮. কেন্দ্রীয় সরকারের সরাসরি নিয়ন্ত্রণ

বিলের ধারা : ওয়াক্ফ নিবন্ধন, অডিট, হিসাব সম্পর্কিত নিয়মাবলি এখন কেন্দ্রীয় সরকার প্রণয়ন করবে।

মুসলিমদের আপত্তি : এটা ওয়াক্ফ ব্যবস্থাপনায় কেন্দ্রের একতরফা নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করছে। ওয়াক্ফ বোর্ড বা স্থানীয় নেতৃত্বের ক্ষমতা খর্ব হয়ে ধর্মীয় স্বাধীনতা লঙ্ঘিত হচ্ছে।

৯. বোহরা ও আগাখানি সম্প্রদায়ের জন্য পৃথক বোর্ড

বিলের ধারা : শিয়া ওয়াক্ফ বোর্ডের পাশাপাশি বোহরা ও আগাখানিদের জন্য পৃথক বোর্ড গঠনের সুযোগ রাখা হয়েছে।

মুসলিমদের আপত্তি : এটি মুসলিমসমাজকে ধর্মীয়ভাবে আরো খণ্ডিত করতে পারে। পৃথক বোর্ডের মাধ্যমে সরকার সম্প্রদায়ভিত্তিক বিভাজন সৃষ্টি করছে বলে ধারণা।

এসব বিষয় মিলিয়ে মুসলমানদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, এটি ওয়াক্ফের ইসলামি মৌলিক ধারণা ও মালিকানা কাঠামোকে দুর্বল করে এবং ধর্মীয় স্বায়ত্তশাসনের ওপর হস্তক্ষেপ করে।

ওয়াক্ফ সংশোধনী বিল ২০২৫ শুধু একটি আইনগত বিষয় নয়; এটি ভারতের মুসলমানদের ধর্মীয় স্বাধীনতা, সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার ও সামাজিক নিরাপত্তার ওপর সরাসরি আঘাত। এই বিল মুসলমানদের ইতিহাস, সম্পদ ও অস্তিত্বকে মুছে ফেলার এক নীরব যুদ্ধে ব্যবহৃত হচ্ছে। এটি সেই দীর্ঘ পরিকল্পনার অংশ, যেখানে মুসলমানদের একপাশে সরিয়ে রেখে একটি একজাতিক, একধর্মীয় রাষ্ট্রের দিকে ভারতকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে।

এখন প্রশ্ন হলো—বিশ্বমুসলিম কি চুপ করে থাকবে? নাকি সংগঠিত হয়ে, আইনত ও সাংগঠনিকভাবে এর বিরুদ্ধতা করবে? কারণ ওয়াক্ফ শুধু জমি নয়, এটি আমাদের আত্মপরিচয়, ইতিহাস ও আমানত। আর আমানতের হেফাজত করা ঈমানেরই অংশ।

By admin

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *